Sunday, November 24, 2024
Homeফিচারচীনের মহাপ্রাচীর

চীনের মহাপ্রাচীর

 

বিশ্বের সবচেয়ে বড় মনুষ্যসৃষ্ট স্থাপনা হচ্ছে চীনের গ্রেট ওয়াল বা মহাপ্রাচীর। এটি পৃথিবীর প্রাচীন সপ্তাশ্চর্যগুলোর মধ্যে একটি। চীনা ভাষায় গ্রেট ওয়ালকে বলা হয় “ছাংছেং”, যার আভিধানিক অর্থ “দীর্ঘ প্রাচীর। মাটি, ইট, পাথর, কাঠ ও অন্যান্য পদার্থ দিয়ে তৈরি পৃথিবীর এই দীর্ঘতম প্রাচীরটির দৈর্ঘ্য প্রায় ২১,১৯৬.১৮ কিলোমিটার (১৩,১৭০.৬৯ মাইল) এবং উচ্চতা ৫ থেকে ৮ মিটার। প্রাচীরটি চওড়ায় প্রায় ৯.৭৫ মিটার।

খ্রিস্টপূর্ব সপ্তম শতাব্দী থেকে খিস্ট্রীয় ষোড়শ শতাব্দী পর্যন্ত সময়ে চীনের উত্তর সীমান্ত রক্ষা করার জন্য এই প্রাচীর তৈরি করা হয়। এ সময় প্রায় একইরকম অনেকগুলো প্রাচীর তৈরি করা হয়েছিল, তবে খ্রিস্টপূর্বাব্দ ২২০ থেকে ২০০ খ্রিস্টপূর্বাব্দের মধ্যবর্তী সময়ে চীনের প্রথম সম্রাট ছিন শি হুয়াংয়ের অধীনে নির্মিত প্রাচীরটিই সবচেয়ে বিখ্যাত। এটি বর্তমান প্রাচীরের একেবারে উত্তরে অবস্থিত এবং এর খুব সামান্যই অবশিষ্ট আছে। বর্তমান প্রাচীরটি মিং রাজবংশের শাসনামলে নির্মিত হয়।

ইতিহাস থেকে জানা যায়, চীনের উত্তর প্রান্তে ছোট-বড় অনেকগুলো রাজ্য ছিল। এসব রাজ্যের কাছাকাছি নানা যাযাবর জাতি বাস করত। এদের মধ্যে ছিল মাঞ্চুরিয়া আর মঙ্গোলিয়ার যাযাবর দস্যুরা। এরা ছিল লুটেরা ও দুর্ধর্ষ যোদ্ধা। চীনের রাজ্যগুলোর সীমানা পেরিয়ে প্রায়ই আক্রমণ চালাত। লুট করে নিয়ে যেত ক্ষেতের ফসল আর গবাদি পশু। মাঝেমধ্যে গ্রামবাসীদেরও ধরে নিয়ে যেত। এই যাযাবর দস্যুদের হাত থেকে রাজ্য ও রাজ্যের মানুষকে রক্ষা করার জন্য সীমান্তে প্রাচীর নির্মাণের কাজ শুরু হয়।

খ্রিস্টপূর্ব সপ্তম শতাব্দীতে এই প্রাচীর নির্মাণের কাজ শুরু হয়। বিভিন্ন সময় বিভিন্ন রাজা এই প্রাচীরের বিভিন্ন অংশ তৈরি করেন। তবে এর মূল অংশের নির্মাণ শুরু হয়েছিল প্রায় খ্রিস্টপূর্ব ২০৮ সালের দিকে। চীনের প্রথম সম্রাট ছিন শি হুয়াং এটি প্রথম ব্যবহার করেছিলেন এবং শত্রুর হাত থেকে নিজের সাম্রাজ্যকে রক্ষার জন্য দীর্ঘ প্রাচীর নির্মাণ করেছিলেন। তিনি চীনের ছোটবড় রাজ্যগুলো দখল করে এক বিরাট চীন সাম্রাজ্য গড়ে তোলেন। আর সেজন্যই বিভিন্ন স্থানে গড়ে তোলা খণ্ড খণ্ড প্রাচীরগুলো যুক্ত করে তিনি উত্তর সীমান্তে গড়ে তোলেন এই মহাপ্রাচীর।

সম্রাট শি হুয়াংয়ের পর হান, সুই, নরদান ও চিং সাম্রাজ্যের সময়েও প্রাচীরের নানা অংশ নির্মাণ ও মেরামত করা হয়। এই মহাপ্রাচীর চীনের লিয়াওনিং প্রদেশ থেকে হেবেই, থিয়ানচিন, বেইজিং, ইনার মঙ্গোলিয়া, শানসি, শাংসি, নিংসিয়া এবং কানসু প্রদেশ দিয়ে পূর্ব থেকে পশ্চিমে বিস্তৃত।

নজরদারীর জন্য মহাপ্রাচীরে নিয়মিত বিরতিতে ওয়াচ টাওয়ার রয়েছে, যা অস্ত্র সংরক্ষণ, আশ্রয় নেওয়ার দুর্গ এবং ধোঁয়ার সংকেত প্রদানে কাজে লাগত। এই ওয়াচটাওয়ারগুলোতে বিশেষভাবে প্রশিক্ষিত সৈন্যরা সবসময় শত্রুর আক্রমণের জন্য প্রস্তুত থাকত। সাধারণত, ওয়াচটাওয়ারগুলো স্থাপন করা হত পাহাড়ের উপরে, যাতে অনেক দূরের শত্রুর অবস্থানও দেখা যায়। যদি দিনের বেলায় শত্রুরা আক্রমণ করত, তাহলে ওয়াচটাওয়ারে অবস্থান করা সৈন্যরা আগুন জ্বালিয়ে ধোঁয়ার মাধ্যমে অন্যান্য ওয়াচটাওয়ারের সৈন্যদের প্রস্তুতি গ্রহণের বার্তা প্রেরণ করত। রাতে শত্রুপক্ষ আক্রমণ করলে লণ্ঠন জ্বালিয়ে বার্তা দেয়া হত। দেখার সুবিধার জন্য পাহাড়সহ অন্যান্য উঁচুস্থানে ওয়াচটাওয়ার স্থাপন করা হয়েছিল। মিং রাজবংশের সময়ই মূলত মহাপ্রাচীরে এসব প্রতিরক্ষামূলক ব্যবস্থা মজবুত করে গড়ে তোলা হয়। মহাপ্রাচীর চীনের ইতিহাসে অনেক গুরুত্বপূর্ণ ঘটনা প্রত্যক্ষ করেছে, যেমন ছিন রাজবংশ দ্বারা ছয়টি রাজ্যের একীকরণ এবং বিদেশি আক্রমণের বিরুদ্ধে মিং রাজবংশের প্রতিরক্ষা।

মহাপ্রাচীরের স্থাপত্য শৈলী বিশ্বের নির্মাণ ইতিহাসের একটি বিস্ময়। ১৯৮৭ সালে ইউনেস্কো মহাপ্রাচীরকে ওয়ার্ল্ড হেরিটেজ এর অন্তর্ভুক্ত করে। বর্তমান সময়ে প্রাচীরের বিভিন্ন অংশ কেটে রাস্তা তৈরি করা হয়েছে এবং শত বছর ধরে পরিত্যক্ত থাকার কারণে বিভিন্ন জায়গায় তা ভেঙে গিয়েছে। তবে মহাপ্রাচীর চীনা সংস্কৃতির অন্যতম এক শক্তিশালী প্রতীক। এই প্রাচীর চীনা জনগণের কঠোর পরিশ্রম, প্রজ্ঞা, দৃঢ়তা এবং অধ্যবসায়ের প্রতিনিধিত্ব করে। মহাপ্রাচীর চীনের পর্যটন শিল্পের একটি গুরুত্বপূর্ণ অংশও বটে, যা সারা বিশ্বের পর্যটকদের আকৃষ্ট করে।

লেখক
মো: এনামুল হক
প্রভাষক, কুয়াংতং ইউনিভার্সিটি অফ ফরেন স্টাডিজ
কুয়াংচৌ, চীন।

RELATED ARTICLES

LEAVE A REPLY

Please enter your comment!
Please enter your name here

Most Popular

Recent Comments